culive24desk : হিংস্র জন্তুর ডাক থামিবে – পথের বাধা হবে শেষ,
বুক ফুলিয়ে বলে উঠবো এই তো আমার দেশ” (রমেশ শীল)
কবিয়াল মদন সরকার-এর ভাষ্যে, ‘দুই কবি দুই পক্ষে থাইক্যা কথা কাডাকাডি, সাথে দোহার, ঢুলি থাকত।_এইডা হইল কবিগান। এইডা বাক্যযুদ্ধ। আমি কইতাম আমার কথা, হে কইত তার কথা। কার কথাডা দামী সেইডা বিচার করত শ্রোতাগণ।’
কবিয়ালরা প্রত্যেকেই স্বভাবকবি ; তারা গদ্যে কিছু বলেন না। যা বলেন সব পদ্যে বলেন। আগেকার দিনের কবিগানে ঢোলক, কাঁসা আর হার্মোনিয়ামের ব্যবহার ছিলো বেশি । আজ থাকছে মুক্ত মনের কবিয়াল সম্রাটের কথা ।
ঢাকার হরিচরণ আচার্য ও তাঁর সম্প্রদায় কবিগানে ‘ভাষায় ও উপস্থাপনায় শালীনতা ও সমুন্নতি এনেছিলেন। হরিচরণ যুগেই ‘অঞ্চল প্রীতির স্থলে স্বদেশ প্রীতি এবং জাত-পাত সাম্প্রদায়িকতা স্থলে উদার মানসিকতার হাওয়া লেগেছিল’।
কিন্তু তখনও কবিগানে দেশচেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনার, উদার মানবিকতার সঙ্গে সংগ্রামী বাস্তবতার, অসা¤প্রদায়িক লোকায়ত ধর্ম প্রবাহের সঙ্গে শ্রেণি চেতনার সমন্বয় ঘটেনি।
হরিচরণের এই অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন করেন রমেশ শীলের নেতৃত্বে ফণী বড়–য়া, রাইগোপাল, এয়াকুব আলী, হেমায়েত আলী প্রমুখ কবিয়াল। রমেশ শীলের শিল্পীত উপস্থাপন ও মার্জিত শব্দচয়ন কবিগানে রুচিশীলতার এক বিরল দৃষ্টান্ত।
যেমন- ‘ব্যবসার ছলে বণিক এল/ ডাকাত সেজে লুট করিল/ মালকোঠার ধন হরে নিল- আমারে সাজায়ে বোকা;/ কৃষক মজদুর একযোগেতে/ হাত মেলালে হাতে হাতে/ শ্বেতাঙ্গ দুষমনের হতে- যাবে জীবন রাখা। অথবা- ‘দেশ জ্বলে যায় দুর্ভিক্ষের আগুনে/ এখনো লোকে জাগিল না কেনে’।
১৮৭৭ সালের ৯ মে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় শীলপাড়ার অতিসাধারণ এক হতদরিদ্র ঘরে রমেশ চন্দ্র শীলের জন্ম। তৃতীয়/মতান্তরে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পিতৃহারা হন। তাঁর উপর নেমে আসে পরিবারের ছয় সদস্যের ভার। জীবিকার তাগিদে চলে যান তৎকালীন বার্মায় । মন টেকেনি, তাই, ১৮ বছর বয়সে ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। পেশা হিসেবে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছিল পৈতৃক পেশা ক্ষৌরকর্ম, স্বর্ণশিল্পী, মুদি-চালের গুদামে চাকরি, শল্য-কবিরাজি-হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা।
চট্টগ্রামের মাঝিরঘাটে কবিগান পাগল বন্ধুদের সাথে জগদ্ধাত্রী পূজায় গান শুনতে গিয়েছিলেন রমেশ শীল। দুই প্রবীণ কবিয়াল মোহন বাঁশি ও চিন্তাহরণের কবিগানের আসর। আসরে উঠে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবিয়াল চিন্তাহরণ। গলা বসে গেল, পদ শোনা যায় না। তখন মাইকের ব্যবহার ছিল না। শ্রোতাদের মধ্যে দেখা দেয় চরম উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা। আয়োজকরা ঘোষণা দিলেন, আসরে কোনো কবি থাকলে মঞ্চে আসার জন্য। বন্ধুরা মিলে রমেশ শীলকে উঠিয়ে দিলেন আসরে।
ভয়ে কাঁপা পায়ে আসরে উঠলেন তিনি। কবিগানের পরিচয় পর্বে প্রতিপক্ষ প্রবীণ মোহন বাঁশি রমেশ শীলকে পুঁচকে ছোঁড়া, নাপিত… বলে অশোভন ভাষায় আক্রমণ শুরু করেন। উত্তরে রমেশ শীলের প্রথম পদ ছিল- ‘উৎসাহ আর ভয়/লজ্জাও কম নয়/কেবা থামাইবে কারে?/পুঁচকে ছোঁড়া সত্য মানি/ শিশু ধ্রুব ছিল জ্ঞানী/চেনা-জানা হোক না এই আসরে…।’
শুরু কবিগানের লড়াই। প্রবীণ-বিজ্ঞ মোহন বাঁশির সাথে জীবনের প্রথম কবিগানেই লড়াই চলল টানা ১৮ ঘণ্টা। কেউ কাউকে হারাতে পারছেন না। শেষতক আপোষ জোঁকের ব্যবস্থা করলেন আয়োজকেরা। গান শুনতে গিয়ে ২১ বছর বয়সেই রমেশ হয়ে গেলেন কবিয়াল। ১৮৯৭ সালের কথা।
প্রথম দিকে তিনি প্রথাগত কবিয়ালদের মত হিন্দু-মুসলমান ধর্মশাস্ত্র, আধ্যাত্মিকতা ও কিংবদন্তী নির্ভর গান রচনা করতেন। গানের বিষয় ছিল নারী-পুরুষ, সত্য-মিথ্যা, গুরু-শিষ্য, সাধু-গেরস্থ ইত্যাদি। পরবর্তীকালে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত কবি সমাজ আর দেশ সচেতন হয়ে ওঠেন, প্রতিবাদ – অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবতার আহ্বানে সকলকে কবিরসে সিঞ্চিত করতে থাকেন #রমেশ শীল ।
১৯২৩ সালে #সুফিবাদের সাধন কেন্দ্র #মাইজভান্ডার শরিফে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে মানবতাবাদী জীবনাদর্শ তাঁকে আকৃষ্ট করে। একনাগারে সাত বছর সুফিবাদের প্রাণ কেন্দ্র মাইজভান্ডারী গান রচনা করেছেন তিনি। তাঁর গাওয়া ও রচিত মাইজভান্ডারী গান এখনো ভক্ত, অনুরক্তসহ মানুষের মুখে মুখে ফিরে। বহু গান এখনো লোকপ্রিয়তার শীর্ষে। যেমন-গাউছেল আজম বাবা নূরে আলম, বা ইস্কুল খুইলাছে রে মাওলা ইস্কুল খুইলাছে…প্রভৃতি।
এছাড়াও তিনি রাঙ্গুনীয়া উপজেলার কাউখালী সিরাজ শাহ ও পটিয়া উপজেলার সাতগাছিয়ার মৌলানা আবুল খায়ের সুলতানপুরীর প্রতিও তিনি অনুরক্ত হন। পীর সৈয়দ গোলামুর রহমানের কাছে দীক্ষা নেয়ায় নিজ সমাজে ধিকৃত হন, তার আশংকা ছিল মৃত্যুর পরে হয়তো তার দাহও করা হবে না, যদিও তার মতে বোয়ালিয়ার সমাজ তাকে একঘরে করেছে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পাওয়ার জন্যে কারণ, অবিভক্ত বাংলায় কমিউনিস্ট মানেই ছিল নাস্তিক, অন্ধ সমাজ এর ভেতরকার অর্থ বুঝতে পারেনি !
১৯৪৮ সালে এক ওসিয়তনামায় সাধকপুরুষ শ্রীমৎস্বামী জগদানন্দপুরী মহারাজের শিষ্য বলে তিনি লিখে যান। এই ওসীয়তনামায় তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন চট্টগ্রামের দেওয়ানজী পুকুরের দত্তত্রৈয়ী আখড়ার গঙ্গাগীর, রথের পুকুর পাড়ের বালকসাধু ও সীতাকুন্ড শংকর মঠের জ্যোতিষানন্দের প্রতি।
অধ্যাপক যতীন সরকারের ভাষায় ”কবিগানের মতো বিস্মৃতপ্রায় একটি লৌকিক শিল্প প্রকরণ নিয়ে যখন মঞ্চে প্রবেশ করলেন চট্টগ্রামের কবিয়াল রমেশ শীল, তখনই গণচিত্ত ফ্যাসি-বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে আপন অধিকারচেতনায়ও উদ্বুদ্ধ হলো, প্রগতি-চেতনার সঙ্গে ঐতিহ্যিক লোক-চেতনার মিশ্রণে কেমন করে যথার্থ গণশিল্প-সংস্কৃতি সৃষ্টি হতে পারে—তারও বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেল’’।
১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পরাজয়ের পরে কবিগান বন্ধ হয়ে যায়। রমেশ ব্রিটিশ সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কলম ধরলেন। তিনি লিখলেন- ‘পাঁচ গজ ধুতি সাত টাকা/দেহ ঢাকা হয়েছে কঠিন/রমেশ কয় আঁধারে মরি/পাই না কেরোসিন।’
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত কবিয়াল রমেশ শীল সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। তার গণসঙ্গীত দেশের মানুষদের এই সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
ব্যক্তিজীবনে চিকিৎসক এবং কবি-প্রাবন্ধিক-গবেষক, ভাষা সংগ্রামী হিসেবে সুপরিচিত আহমদ রফিকের স্মৃতিতে – ”বায়ান্ন সালের আগস্ট মাসে কুমিল্লায় সাহিত্য সম্মেলন হলো। আমি, গাজিউল হকসহ বেশ কিছু ছাত্র কুমিল্লা গিয়েছিলাম অনেক কষ্ট করে। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না। যেখানে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, প্রগতিশীল গান থেকে শুরু করে বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটক এবং বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীল এবং ফনী বড়ুয়ার কবিগানের আসর বসেছিল। এখানে পালা হয়েছিল ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ অর্থাৎ কতটা আধুনিক রূপ লাভ করেছিল। এই কবি গানগুলো ইশ্বর পাঠশালার চত্বরে বসে মাদুর পাতা, হোগলা পাতার চত্বরে বসে রাতভর শুনেছিলাম। অসাধারণ ছিল এই পালা গান।”
কবিয়াল রমেশ শীল ১৯৫৪ সালে ঢাকায় বসে রচনা করেছিলেন ‘বাংলা ভাষায় হাসি কাঁদি স্বপন দেখি দিবানিশি, চিরদিন বাংলার আশা, বাংলাদেশে করি বাসা, বাংলা আমার মাতৃভাষা, বাংলায় প্রত্যাশী।’
১৯৫৪ সালে জণগণের ভোটে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং নুরুল আমিনকে পূর্ববাংলার গভর্নর বানানো হয়। এই নুরুল আমীন চট্টগ্রামে এলে জনগণের কাছে লাঞ্চিত হন। এই নিয়ে রমেশ শীল বিখাত একটি ব্যাঙ্গাত্মক গান রচনা করেন। গানটি হচ্ছে,
শোন ভাই আজগুবি খবর
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন করে চট্টগ্রাম সফর।
দিনের তিনটা বেজে গেল পল্টনে সভা বসিল
হায় কি দেখিলাম কি ঘটিল।
মানুষ ভয়ে জড়সড়
হঠাৎ দেখি পচা আণ্ডা
মন্ত্রীকে করিতেছে ঠাণ্ডা।
উড়তে লাগলো কাল ঝাণ্ডা,
মন্ত্রীর চোখের উপর।
বিপ্লবী চট্টগ্রাম গেলা সূর্যসেনের প্রধান কেল্লা
মন্ত্রী করে তৌব্বা তিল্লা,
করবো না জনমভরে চট্টগ্রাম শহর।
এই গানটি এতো জনপ্রিয় পেয়েছিল যে তা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জন্য তাকে কারাগারে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন। এই সময় তার বয়স হয়েছিল সত্তর বছর এবং তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। সেই সময় তাকে অঢেল বিত্তবৈভবের লোভ দেখিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত লেখার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখান করেন। এই প্রলোভনের জবাব দিয়েছিলেন তিনি নিচের কবিতা দিয়ে,
আমার খুনে যারা করেছে মিনার
রক্তমাংস খেয়ে করেছে কঙ্কালসার
আজ সেই সময় নাই ত্বরা ছুটে আসো ভাই
বেদনা প্রতিকারের সময় এসেছে।
উল্লেখ্য ১৯৪৪ সালে কবি রমেশ শীল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে জোরাল অবস্থান নিয়েছিলেন। যে কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার পরে অন্যান্য নেতা-কর্মীর সাথে রমেশ শীলকেও গ্রেফতার করা হয়। তার ‘ভোট রহস্য’ পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার। কবি দীর্ঘ্যদিন কারাভোগ করেন এসময়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরোধিতা করায় রমেশ শীলের সাহিত্য ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গান, কবিতা, যাই লিখতেন সেগুলো কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে সংরক্ষণ করতেন রমেশ শীল। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেরাও বাবার গানগুলো একইভাবে সংরক্ষণ করেন। এরকম পুঁটলি ছিল ১৮টি। ব্যয়ভারের অভাবে পা-ুলিপিগুলো মুদ্রণ সম্ভব হয়নি।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে পাক-হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসরেরা তাঁর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি আর্মির ভয়ে পালানোর আগে রমেশ শীলের ছেলে পুলিন শীল একটিমাত্র পুঁটলি সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন। বাকি ১৭টি পুঁটলি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রাজাকাররা রমেশ শীলের হারমোনিয়ামও লুট করে। সে অর্থে তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টি হারিয়ে যায় ।
১৮৯৯ সালে কোনো এক কবিগানের আসরে পরপর তিনজন কবিয়ালকে পরাজিত করেছিলেন রমেশ শীল। ঘোড়ার গাড়িতে করে তাকে আসরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সম্মানি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল নগদ আট টাকা। আর পুরস্কার পাঁচ টাকা। এই অর্থ রমেশ শীলের পেশাকে বদলে দেয়। একের পর এক কবিগানের বায়না নিতে থাকেন তিনি।
কবিয়ালরাও কবির লড়াই করতে করতে একসময় সংগঠিত হয়ে উঠে। অশ্লীলতা আর কুরুচিতে পূর্ণ কবিগানকে সামন্তপ্রভুদের মনোরঞ্জনের উপকরণ হতে মুক্ত করার তাগিদে ‘কুরুচিপূর্ণ গান ছাড়’ এই শ্লোগানে ঐক্যবদ্ধ হন কবিয়ালরা, এতে নেতৃত্ব দেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবিয়াল রমেশ শীল। উদ্দেশ্য ছিল সুস্থ ধারার বিনোদন, দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ।
চল্লিশের দশকে কবিয়াল ফনী বড়ুয়া ছিলেন তেজোদীপ্ত তরুণ , ১৯৪৩ সালে ফনী বড়ুয়ার বাড়ির পার্শ্ববর্তী বাগোয়ান গ্রামে ‘চট্টগ্রাম জেলার’ কৃষক সম্মেলন হয়। বাঘোয়ানের দু’দিন ব্যাপী কৃষক সম্মেলনের পরে চট্টগ্রাম জেলা কবি সমিতি নামে ফনী বড়ুয়ার পাঁচখাইন বাড়িতে একটি কবিয়াল সংগঠনের জন্ম লাভ করে। এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন রমেশ শীল, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফনী বড়ুয়া ।
রমেশ শীল কবিগানের দল নিয়ে চট্টগ্রামের বাইরে প্রথম বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে যান ১৯৪৫ সালে।
আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কে রমেশ শীল ছিলেন সচেতন। তাঁর গানের বাণী ছিল শান্তির পক্ষে। অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সূর্যসেন–প্রীতিলতার বীরত্বগাথা প্রভৃতি বিষয়ও তাঁর গানের অনুষঙ্গ হয়েছে। কোনো কোনো গানে কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদার আর শোষকের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে তীব্র প্রতিবাদ। এসেছে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার আহ্বান।
১৯৪৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ এর তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলনে কবিগান করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরস্কারধন্য শেখ গোমানীর সঙ্গে। ওই আসরে রমেশ শীলের সহকারী ছিলেন ফনী বড়ুয়া, ঢোলকে ছিলেন বিনয়বাঁশী। আজীবন ধর্মান্ধতা কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যিনি সব সময় প্রতিবাদী ও সোচ্চার ছিলেন তিনি উপমহাদেশের আরেক খ্যাতনামা কবিয়াল ফণী বড়ুয়া।
সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিলেন সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ বাংলার বিখ্যাত সব মানুষ। সেই আসরে গান আপসমূলক জোটক দিয়ে শেষ হলেও শ্রোতারা রমেশ শীলকে অভিনন্দিত করে জয়ীপক্ষ হিসেবে। কলকাতার সংবাদপত্রে লেখা হলো ‘ it was obvious that any day Ramesh could beat most speakers hollow’.
রমেশ শীলের শিষ্য ফণী বড়ুয়া আর বিনয়বাঁশী জলদাশ সম্পর্কে খুব স্বল্প পরিসরে হলেও না বললেই নয় ।
কবিয়াল ফনী বড়ুয়া চট্টগ্রামের রাউজানে জন্ম, জীবিকার জন্য বৌদ্ধ কীর্তন গাওয়া ও রং লাগানো কাজ করতেন। তার রং লাগানোর দোকানে তিনি টর্চ মেরামত, ঘড়ি সারানোর কাজ, ঝালাইসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন।
১৯৩০ এর দশক থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত বীর দর্পে প্রতিটি দেশ ও জাতির সংকটপূর্ণ মুহূর্তে কবিগানের মাধ্যমে গণজাগরন সৃষ্টি করেছেন।
যিনি পাকিস্তানি রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় গেয়েছিলেন– “ছয় দফার জয় হল ভোটে/ মুসলিম লীগের পতন ঘটে, জয় বাংলার পতাকা দিল তুলি/ কেন বাংলার বাংলাভাষী– সাজিল আজ বাংলাদেশী। বাঙালি জাতীয়তা ভুলি। বাংলাদেশী জাতীয়তা, সাম্প্রদায়িক জন্মদাতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা পদদলি।
রমেশ শীলের গ্রামেই জন্ম বিনয়বাঁশী জলদাশের,বাবা ঢোলবাদক ছিলেন বলেই তিনি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছেন যুগপৎ। পারিবারিক পেশা মৎস্য শিকারের চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল তাঁর ঢোলে। ঢোলের বোলে তিনি বিভিন্ন পশুপাখির ডাক, ঝড়বৃষ্টি মেঘের নানা রকম শব্দ, নৌকার দাঁড় বাওয়ার শব্দছন্দ, যানবাহনের শব্দ ইত্যাদি মজাদারভাবে পরিবেশন করতেন অভিনব দেহভঙ্গিমায়, মুগ্ধ হয়ে যেত জেলেপাড়া । যৌবনে রমেশ শীলের মতো তাঁরও হাতেখড়ি হয় মার্কসবাদী রাজনীতিতে।
পটিয়ার এক কবি গানের আসরে রমেশ শীলের কবিগান শুনে মুগ্ধ বিনয়বাঁশী। সেই সূত্র ধরে একদিন রমেশ শীলের বাড়িতে হাজির হয়ে বিনয়বাঁশী বললেন, ‘আমি আপনার সাথে ঢোল বাজাবো। বিনয়কে বুকে টেনে নেন কবিয়াল রমেশ শীল।
১৯৪৫ সালে রমেশ শীলের দোহার/বাদ্য সঙ্গী হিসেবে কলকাতার ‘‘নিখিল বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে’যোগ দেন। বিনয়বাঁশীর ঢোল বাজনায় মুগ্ধ হয়ে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নটরাজ উদয় শংকর তাঁর নৃত্যদল ‘মম বাণীতে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানান। দৃষ্টিনান্দনিকতার মূল উপাদান তাঁর অপরূপ নৃত্যভঙ্গিমা। তাতে সাড়া দেননি বিনয়বাঁশী।
কবিয়াল রমেশ শীলের সাথেই ঢোল নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে। ঢোল বাদন ছাড়াও সানাই, বেহালা, দোতারা, করতাল, মৃদঙ্গ বাজানোয় পারদর্শি ছিলেন বিনয়। ১৯৩৮ সাল থেকে একাধারে ২৫ বছর কবিয়াল রমেশ শীলের সাথে ঢোল বাজিয়ে গেছেন বিনয় বাঁশী। ১৯৫৬সালে কাগমারী ও ঢাকার কার্জন হলের সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ঢোল বাজান বিনয় বাঁশী।
নব্বই দশকেওও অধিক অব্যহত রেখেছেন ঢোলের বাড়ি, ২০০২ সালে চলে যান ঢোল নামিয়ে পরিচর্যা ও চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয়নি দারিদ্র্যের কারণে, প্রগতিশীল মহল থেকে কোনো হাত এগিয়ে আসেনি !
১৯৬৩ সনে চট্টগ্রামের বিপ্লবী জননেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদার লোককবি রমেশ শীলের সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করেন ‘কবিয়াল রমেশ শীল’ নাম দিয়ে। স্বাধীনতার পরে রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কলিম শরাফী কবিয়াল রমেশ শীলের জীবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন, ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমী ৫৩৫ পৃষ্ঠার ‘রমেশ শীল রচনাবলী প্রকাশ করে।
রমেশ শীল তাঁর জীবৎকালে সংঘটিত অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, আত্মাহুতি, দুর্ভিক্ষ, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, ভাষা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা, মানবতা, সামাজিক অবিচার, শোষণ, কুসংস্কার আর গোড়ামি ইত্যাদি নিয়ে গান বেঁধে জনগণের মনে চেতনা জাগিয়েছেন, আমরা চেষ্টা করবো তার সৃষ্ট সংগীতকে পরবর্তীতে এই পেইজের মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে দিতে । আমরা স্বপ্ন দেখি রাজধানী থেকে মফস্বল ও প্রান্তিক জনপদে বইমেলা এবং অন্যান্য মেলাতে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে কবিয়াল আর কবিগানের লড়াই ।
প্রচলিত আছে , ১৯৬৭ সালের আশ্বিন মাসের এক ভরা পূর্ণিমায় কর্ণফুলি নদীর তীরে কবিয়াল রমেশ শীল তাঁর শিষ্য রাইগোপালকে শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠে বলেছিলেন, আমার জইন্যে কবর খুঁইড়া রাখিয়ো রাইগোপাল । আমার যাওনের সময় হইছে !
কবিয়াল সম্রাট রমেশ শীল ১৯৬৭ সালের ৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন, তাকে সমাধিস্থ করা হয় ।
Leave a Reply