বার বার ব্যর্থ হওয়া ফয়সালের সফলতার গল্প
ভর্তিযুদ্ধে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পর যেকোন শিক্ষার্থীই নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যেতে পারে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটা সবার পক্ষেই সম্ভব হয় না। যারা বার বার ব্যর্থতার পরেও নিজের জায়গায় অটল থাকতে পারে তারাই শেষ পর্যন্ত সফলতার গল্প লিখতে পারে। আজকে এমনি একজনের গল্প আপনাদেরকে বলব যার সফলতার গল্পটি খুব একটু ব্যতিক্রম। এই আর্টিকেল শেষ পর্যন্ত পরলেই জানতে পারবেন কেন ফয়সালের সফলতা একটু ব্যতিক্রম।
আগের আর্টিকেলে আমরা বলেছিলাম অমিতের স্বপ্নজয়ের গল্প এবং ফারাভীর চবিতে চান্স পাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে। সেই ধারাবাহিকতায় আজকে আমরা ফয়সালের কাছ থেকেই তার গল্পটি শুনব।
তাহলে চলুন আর কথা না ফয়সালের সফলতার গল্প শুনে আসি।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা সত্যিকার অর্থেই একটি তিক্ত অভিজ্ঞতা। মনে থাকে কোথাও চান্স না পাওয়ার ভয়। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ লক্ষণীয়। কারণ তাদের পরিবারের কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ানোর সামর্থ্যটা থাকে না। আর মেধাবীদের মাঝে থাকে কোথাও না হলে আশেপাশের মানুষের কাছে মুখ দেখাবে কিভাবে। আমিও ঠিক তেমনি একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমরা ছেলেরা বা মেয়েরা সাধারণত বড়দের মত চিন্তা ভাবনা করতে শিখি অথবা তাদের মত কঠিন সিদ্ধান্ত গুলো নেয়া শিখি ১৫ বা ১৬ বছর বয়স থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার মত কঠিন এবং জটিল সিদ্ধান্ত আমাদের মাত্র ১৮ বছর বয়সেই নিতে হচ্ছে। একটি ভুল সিধান্ত আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। ভেঙ্গে দিতে পারে আমদের গড়ে তোলা স্বপ্নগুলো। আজ আমি বর্ণনা করবো আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার অভিজ্ঞতা।
আরো পড়ুন
আমি স্কুল কলেজের সেরা ছাত্র কখনই ছিলাম না। অবশ্য খারাপও লাগতো যে কখনো স্কুল কলেজে ফার্স্ট হতে পারিনি। তবে আমি আমার পরিবার, শিক্ষক এবং প্রতিবেশী সিনিয়র ভাইয়া আপুদের কাছে একটি মোটিভেশন পেয়েছি সেটা হল আসল খেলা হবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়। এই কথাটাই আমার মত সাধারণ ছাত্রকে বুয়েট, ঢাকা মেডিক্যাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়ার স্বপ্ন যুগিয়েছে। নিজেকে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। তবে মনে সবসময় একটা ভয় থাকতো সেটা হল কোথাও চান্স না পেলে কি হবে। অনেক চিন্তাই মাথায় ঘুরত। অবশ্য ঘোরাটাই স্বাভাবিক । কারণ আমার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা মেডিকেল।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রথমে আঘাত হানে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং এর ক্লাসগুলো। সবাই মিলিটারি স্টাইলে নোট তুলত এবং প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিত। কিন্তু আমি তা পারতাম না এবং পরীক্ষাগুলোতে নাম্বারও কম পেতাম। শুধু আমিই নই আমার মত অনেক ছাত্র ছাত্রী আছে যারা এই ব্যর্থতায় পড়ালেখা ছেড়ে দেয়। আমিও আর ব্যতিক্রম কি। আমিও ছেড়ে দিলাম। এভাবে হয়তো এক সপ্তাহ পড়ালেখা করা হয়নি।
আরো পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়টুকুতে এই একটি সপ্তাহ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা অবশ্য পরে বুঝেছি। কারণ এই এক সপ্তাহে পদার্থ বা রসায়ন বা গণিতের যেকোনো একটি পার্ট খুব ভালোভাবেই শেষ করে ফেলা সম্ভব। যাইহোক কিছু কিছু লোক আছে যারা ইউটিউব এ মোটিভেশন ভিডিও খুঁজে বেড়ায়। আমিও আর কি করবো আমিও খুঁজলাম। অবসর সময়ে বুয়েটের নাটক গুলো দেখতাম। আমার মাঝে হিংসে জাগত আমি কি বুয়েটে পড়তে পারবোনা। আবার পড়া শুরু করতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির এই সময়টাতে নিজেকে পড়াশোনার মাঝে ডুবিয়ে রাখা এবং এই স্রোতটাকে ধরে রাখতে পারা খুব কম মানুষই পারে। আমি অবশ্য পারিনি। মাঝে মাঝেই দুই তিন দিনের জন্য পড়া হত না। এইভাবে আস্তে আস্তে আল্লাহর রহমতে নিজেকে ভালোভাবেই প্রস্তুত করেছিলাম। সুযোগ পেলেই বুয়েট অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নব্যাঙ্ক পরতাম। নিজে নিজে পরীক্ষা দিতাম। যখন দেখতাম বুয়েটের ৬০০ নাম্বারের মধ্যে ৫০০+ আসতো প্রত্যেকটা পরীক্ষায় খুব ভাল লাগতো। পড়তে আরও ভাল লাগতো। এইভাবেই চলে গেল প্রস্তুতির সময়টুকু।
এখন শুরু হবে আসল তিক্ততার অভিজ্ঞতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক ইউনিট এর পরীক্ষা। পরীক্ষা খুব ভাল হয়েছিল। আমি তো খুব খুশি। ফলাফলের দিন একটু টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল যখন দেখলাম পজিশন ৫০০০+। নাম্বার পেয়েছি ৫৩। আমার তখন কান্না পাচ্ছিল। সবারই পাওয়ার কথা। আমার মনে হচ্ছিল তাহলে আমি কি যোগ্য নই। আমি কি সঠিক ভাবে পড়তে পারিনি। তখন সবকিছু নতুন করে পড়ার সুযোগ ও ছিল না। বই নিয়ে পড়তে বসলে মাথায় পড়ার পরিবর্তে আসতো যত দুশ্চিন্তা। এ কারণে পড়াই হয়নি। মেডিক্যাল পরীক্ষা দিলাম না পড়ে। এরপর বুয়েট পরীক্ষা। মন খারাপ।
পরীক্ষার আগের রাতে নিজেকে মোটিভেট করার জন্য বুয়েটের কয়েকটা নাটক দেখলাম। পরীক্ষার দিন। অসাধারণ পরীক্ষা হল। সিনিয়ররা বলল তুমি ১০০–২৫০ এর মধ্যে থাকবা। আমিও খুব কনফিডেন্ট ছিলাম। আমার মনে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছিল এই পরীক্ষাটিই। এর পর দিলাম সাস্ট । পরীক্ষা হল কোনরকম। ফলাফল আসলো ওয়েটিং। মেডিক্যাল এ ফেল করলাম। মনে ভয় ঢুকতে শুরু করলো। কোথাও যদি চান্স না হয়।
সিদ্ধান্ত নিলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও যেন আবার মিস না হয় এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর ফরম ও তুলে রাখতে। বাসায় আসলে আমাকে নিয়ে চিন্তায় পরে গিয়েছিল। কারণ আমার মানসিক অবস্থা ভাল ছিল না। কারণ যে ছাত্র সাস্ট, ঢাবি তে ভাল করতে পারেনি সে আবার বুয়েট কুয়েট রুয়েট চুয়েট এ গিয়ে কি করবে।
রুয়েট পরীক্ষার এর আগে ফলাফল দিল বুয়েট এর। চান্স হল না। সব ঠিক ছিল। আমার নাম ও ছিল। রোল এ শুধু ৩য় ডিজিট টাই মিলে নাই। মাথা নষ্ট হয়ে গেল। বুয়েট এ কল করতে শুরু করলাম। রেজাল্ট ভুল হইসে। খাতা পুনরায় চেক করতে। মাথা শুধু আমারই নয় আমার পরিবারের ও তখন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এমন পরীক্ষা দেয়ার পর মিস হয় কেমনে। আমার উপর থেকে আমার পরিবারের ভরসাও কমে গিয়েছিল। ভেবেছিল আমি হয়তো যা পড়সি ভুল পড়সি। এমন ভাল পরীক্ষা দেয়ার পরও যখন হয় নাই তখন হয়তো আমি পরীক্ষায় ভুলভাল উত্তর করে আসছি এবং বাকি গুলোতেও তাই করবো।
আরো পড়ুন
এরপর কয়েকদিন আমি ঘুমাইতে পারিনাই ঠিকমত। ঘুমাইতে গেলেই বুয়েটের সেই নাটকগুলো ভেসে উঠত। বুয়েটের গেইট, ক্যাফে চোখের সামনে ভেসে উঠতও। রুয়েট এ গেলাম। রুয়েট এর সিনিয়র ভাইয়া এত আন্তরিক ছিল তিনি মোটিভেশন বক্তৃতা দিলেন। পরীক্ষার আগে ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে বুয়েটই সব না। রুয়েট পরীক্ষা দিলাম। প্রশ্ন করেছিল খুব সহজ। সবাই সকল প্রশ্নের উত্তর করল। আমি পারলাম না। সত্যি পরীক্ষা খারাপ হয়েছিল। রুয়েট এর আগে ছিল এমআইএসটি । ওটার পরীক্ষাও খারাপ হল। রুয়েট দেয়ার পর বাসায় আসলাম।
ভাবলাম কুয়েট এর আগে এটাই হয়তো আমার সর্বশেষ সুযোগ সকল কিছু ভালোভাবে পড়ে নেয়ার। কিন্তু পড়া আর হয়নি। কুয়েট পরীক্ষার আগে ব্যর্থতা এবং হতাশায় ভুগতেছিলাম। পরীক্ষা হল কোনরকম। চরম ব্যর্থতা এবং হতাশায় কুয়েট থেকে রওনা দিলাম। মনে হচ্ছিল আমি বাসেই লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করি। সারাদিন মনমরা হয়ে কাটালাম। রাত ১০ টায় রুয়েট থেকে বড় ভাইয়া কল করে জানালো আমার রুয়েট এ চান্স হইসে ভাল পজিশন এ থেকেই। আমার বিশ্বাস হচ্ছিলনা। ভাইয়ারে আমি কয়েকবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার রেজাল্ট আবার চেক করার জন্য।
একজন ভর্তি পরীক্ষার্থী এর জন্য এমন একটা সংবাদ শোনা কতটা আনন্দের তা বোঝানো যাবেনা। এমন আনন্দ শুধু তারাই বুঝতে পারবে যারা পরীক্ষা দিয়েছে। আমার দুঃখের অবসান হল। মনে শান্তি আসলো। ভেবেছিলাম আর কোথাও পরীক্ষা দিতে যাবনা। যাইও নি। এরপর কুয়েট এ ভাল পজিশন এ চান্স হল। এমআইএসটি তে হইল। কুয়েট এ সিভিল এ ভর্তি হলাম। আল্লাহর কাছে আমি আজও অনেক কৃতজ্ঞ যে আল্লাহ আমার মত সাধারণ ছাত্রকে এত বড় নিয়ামত দিয়েছেন। এই হল আমার ভর্তি পরীক্ষার অভিজ্ঞতা। আমি আমার সকল জুনিয়র দের বলব কখনই ধৈর্য হারিয়ো না। আল্লাহের উপর বিশ্বাস রাখো। আল্লাহ তোমাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গাটিই পছন্দ করে রেখেছেন।
আর্টিকেলটি লিখেছেন
ফয়সাল আহমেদ
সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, কুয়েট
ব্যাচঃ ২০১৮-১৯
https://culive24.com/?p=21454উদ্দীপনাগল্পবার বার ব্যর্থ হওয়া,ব্যর্থ মানুষের সফলতার গল্প,সফল ব্যক্তি,সফল মানুষের গল্প,সফলতার উপায়,সফলতার গল্পভর্তিযুদ্ধে বার বার ব্যর্থ হওয়ার পর যেকোন শিক্ষার্থীই নিজের লক্ষ্য থেকে সরে যেতে পারে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটা সবার পক্ষেই সম্ভব হয় না। যারা বার বার ব্যর্থতার পরেও নিজের জায়গায় অটল থাকতে পারে তারাই শেষ পর্যন্ত সফলতার গল্প লিখতে পারে। আজকে এমনি একজনের গল্প আপনাদেরকে...culivehttps://plus.google.com/u/0/me?tab=wX&authuser=0CuLive Portaladmin@culive24.comAdministratorচবির একঝাক মেধাবী তরুন লেখক ও ছাত্র সাংবাদিক বৃন্দ।চবি নিউজ পোর্টাল | Campus News 24/7


Leave a Reply